মোদি সরকারের এক বছর : ফিরে দেখা

July 9, 2015

মোদি সরকারের এক বছর

নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসা প্রায় এক বছর হয়ে গেল। এই এক বছর ধরে তার প্রশাসন প্রচুর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে কিছু পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়, যা এই দেশে কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে আবার কিছু তেমন জনপ্রিয় নয়। মোদিকে নিয়ে সমালোচনা করার সময়, এটা ভাবার প্রয়োজন যে ভারতের মত এত বিশাল একটি দেশের মানুষের জীবনে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন আনা এত তাড়াতাড়ি সম্বব নয়। তাই এইসব কিছুর আগে, তাঁর রাজত্বের প্রথম বছরে মোদি শাসনের সমস্ত ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলিতে কটাক্ষপাত করা যাক –

প্রথম বছরে মোদি সরকার কর্তৃক গৃহীত ইতিবাচক পদক্ষেপ

আজ পর্যন্ত মোদি সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এবং সফলতার একটি তালিকা –

  • ইরাকে আই.এস.আই.এস সঙ্কটের সময় অসহায় ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনা : সাম্প্রতিক সংকটে ইরাকের আই.এস.আই.এস জঙ্গি কর্তৃক বেসামরিক নাগরিকদের বন্দী করার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী শোরগোল শুরু হয়েছিল। ভারত সরকার, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আই.এন.এস মহীশূর জাহাজ মোতায়েন করে, সেখানকার কর্মরত ভারতীয় নার্সদের ফিরিয়ে আনার জন্য।
  • এন.জি.ও-র উপর আই.বি প্রতিবেদনের আনয়ন : আই.বি.(গোয়েন্দা সংস্থা)-র তথ্যে দেখানো হয়েছে যে, এই বিক্ষোভ এন.জি.ও (নন গভর্নম্যান্ট অরগ্যানাইজেশন) দ্বারা সংগঠিত করা হয়েছিল, এরা আর্থিকভাবে অন্যান্য দেশের দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত হয়,ফলে গত কয়েক বছরে জাতীয় জি.ডি.পি (স্থূল ঘরোয়া উৎপাদন)-তে আনুমানিক ২-৩ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। এখন, বিদেশী তহবিল গ্রহন করার পূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেওয়া এন.জি.ও-দের জন্য বাধ্যতামূলক।
  • বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে রেলপথ ব্যবস্থার উন্নতি : সরকার রেলপথের জন্য একটি নতুন ওয়েবসাইট চালু করেছে এবং এটি আই.আর.সি.টি.সি (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন)-র কর্মক্ষমতায় উন্নত মাত্রা এনেছে। ২০১৫ সালের রেল বাজেট এই একই কারণে প্রশংসনীয় এবং এটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে যে, রেলপথ অর্থনৈতিকভাবে একটি ভাল অবস্থায় রয়েছে এবং এটি জাতীয় অর্থনীতির উপর সম্পূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষজ্ঞরাও এই ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন যেভাবে সরকার অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মূলধন উত্থাপন করার চেষ্টা করছেন।
  • রিলায়েন্সের উপর জরিমানা আরোপ : নরেন্দ্র মোদি সরকার সম্প্রতি রিলায়েন্স কোম্পানিতে ৩২০ কোটি টাকার জরিমানা আরোপ করেছেন। মোদি এছাড়াও বলেছেন যে প্রতিটি মানুষের জন্য সমান নিয়ম। এটি অত্যন্ত ভাবে সরকারের সুনামকে পুনরুদ্ধার করেছে।
  • নর্মদা বাঁধের বৃদ্ধি উচ্চতা : এই এলাকার মানুষরা যাতে বেশী পানীয় জল পেতে পারে এবং সেচের কাজে লাগাতে পারে তাই এই কাজটি করা হয়েছে।
  • দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সুবিধা : অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর মানুষদের জন্য সরকার বিনামূল্যে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এবং এম.আর.আই করার প্রধান পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।এই সুবিধা সমস্ত সরকারি হাসপাতালে উপলব্ধ।
  • জাতীয় সড়ক বরাবর বৃক্ষরোপণ : ভারতের জাতীয় সড়ক দ্বারা আচ্ছাদিত এক লাখ কিলোমিটার এলাকায় ২০০ কোটি বৃক্ষ রোপণ করা হবে। এটি তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি বলে আশা করা হচ্ছে। এই একই প্রকল্প জাতীয় প্রশাসন দ্বারা পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং এম.এন.আর.ই.জি.এ (মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট) কর্মসূচির অধীনে থাকা বিভিন্ন জেলা ও গ্রামের রাষ্ট্রীয় সড়ক এবং রাস্তায় এটি প্রয়োগ করা হবে।
  • সুরক্ষা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত পদক্ষেপ : এই বিষয়ে অরুণাচল প্রদেশের সড়ক ও পরিকাঠামো নির্মাণ হল একটি প্রধান পদক্ষেপ। চীনের সীমান্ত বরাবর এলাকায় পোস্ট নির্মিত হচ্ছে। কর্ণাটকের কারওয়ার নৌ-বাহিনী ঘাঁটি দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি এক্সটেনশন পেয়েছেন। সরকার আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে একটি নতুন রেডার স্টেশন স্থাপন করার পদক্ষেপ নিতে চলেছেন, যাতে বঙ্গোপসাগর এলাকাটি যথাযথভাবে নিরীক্ষণ করা সম্ভব হয়।
  • চমৎকার বৈদেশিক নীতি : নরেন্দ্র মোদি একটি অসাধারণ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছেন যা সারা বিশ্বের তথা ভারতীয় দেশ গুলিতে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এখনও পর্যন্ত, তার দ্বারা গৃহীত প্রতিটি বিদেশ সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে। তাঁর অধীনে, ভারতের বৈদেশিক নীতি নতুন মাত্রা পেয়েছে, ভারত ও অন্যান্য দেশের মানুষদের তাঁর প্রতি জনপ্রিয়তার মাত্রাকে সত্যিই ধন্যবাদ জানানো হচ্ছে। মোদি নেপাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভুটানের মত বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটা আশা করা হচ্ছে যে, এই দৃশ্যকল্প ভারতকে আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতি অর্জন করতে সাহায্য করবে, যা সবসময় আশা করা হয়েছে কিন্তু সত্যি হয়নি।
  • অর্থনৈতিক এবং বানিজ্যিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা : বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্যের প্রতি আরও মানুষদের যোগদানকে নিশ্চিত করার জন্য মোদি সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। শেয়ার বাজার ধারাবাহিকভাবে কর্মসঞ্চালন করে চলেছে। এটি ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে সু-স্বাস্থ্যের ইঙ্গিত। বাণিজ্য মন্ত্রী, নির্মলা সিথারমন বিনিয়োগ এবং উদ্যোক্তাদের অন্যান্য কাজকর্মে বাধা সৃষ্টিকারী আইনগত সমস্যা নির্মূল করতে কিছু পরিবর্তন এনেছেন।
  • পরিকল্পনা কমিশনের বিলুপ্তি নির্মূল করা : একদিকে পরিকল্পনা কমিশনের সমাপ্তি নিয়ে অনেকে যেমন সমালোচনা করছেন, সেরকম অনেক বিশেষজ্ঞরা এতে সম্মতি দিয়েছেন যে ইদানীং এই কমিশন বাস্তবে কোন কাজ না করায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। বস্তুত, অরবিন্দ পানাগারিয়া এবং অধ্যাপক বিবেক দেবরায়-এর মতন ব্যক্তিত্বের নীতি আয়োগে অন্তর্ভুক্তি মানুষদের আশ্বাস প্রদান করছে। এখন রাজ্যগুলি এই পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় কাজ করতে এবং সম্পদের বৃহৎ টুকরার অংশীদার হতে একটি বৃহত্তর ভূমিকা পালন করছে।
  • উপযুক্ত এবং বাস্তবসম্মত বাজেট : ২০১৪ সালের বাজেট অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিল এবং আর্থিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে সঠিক স্টক এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়নি কিন্তু ২০১৫ সালের বাজেট প্রকৃতিগত ভাবে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গৃহীত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গুলি হল – ইনসেন্টিভ যা হল একটি প্রধান সিদ্ধান্ত এবং কর ফাঁকি দেওয়াকে দূর করা।
  • বিদ্যুৎ সংকটের সাথে মোকাবিলা : বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সাথে মোকাবিলা করতে বিদ্যুৎ মন্ত্রী, পীয়ুষ গোয়েল বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।বন্দর ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী পরিকল্পনা আনয়নের জন্য নীতিশ গড়করীও অত্যন্ত প্রশংসা লাভ করেছেন।
  • অন্যান্য সংস্করণ : পাসপোর্ট নবীকরণে পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্বারা সম্পন্ন দ্বিতীয় যাচাইকরণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দূর করেছেন। সরকার ধর্ষণ মামলার সাথে মোকাবিলার জন্য ৬৬০-টি সঙ্কট কেন্দ্র স্থাপন করবেন। যার নামকরণ করা হবে নির্ভয়া কেন্দ্র। কিষাণ মান্ডি খাদ্য মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য স্থাপিত হবে।

এছাড়াও অন্যান্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলি হল – গুরুতর ভাবে দূষিত এরকম ১৭-টি শিল্পের বাধ্যতামূলকভাবে ৩২০৬-টি ইউনিট নিরীক্ষণ এবং বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের শক্তিশালীকরণ।

প্রথম বছরে মোদি সরকার কর্তৃক বিপর্যয়ের সম্মুখীনতা

তবে, বিভিন্ন এলাকায় মোদি সরকার এখনও আশানুরূপ কাজ করেননি। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বহু উচ্চাভিলাষী প্রকল্প শুরু করেন; যেমন – পরিচ্ছন্ন গঙ্গা ও স্মার্ট শহর পরিকল্পনা। তবে বাস্তবে এই উভয় পরিকল্পনা, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও ধারণামূলক ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কার্যকরী করা যাচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্ট সময় দিচ্ছে কিন্তু পরিচ্ছন্ন গঙ্গা পরিকল্পনা আরম্ভ না হওয়ায় জাতীয় প্রশাসনকে বারবার সমন পাঠাচ্ছে।

সরকার রেলপথ আধুনিকীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে সেইরকম উন্নতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুপার ফাস্ট ট্রেন এখনও দেখা যায়নি এবং সরকারের পছন্দমত বেসরকারীকরণের ব্যাপ্তিও ঘটেনি। যদিও বহু নিয়মনীতি কার্যকর করা হচ্ছে তবে জনসাধারণের প্রত্যাশাকে এখনও মেটাতে পারেনি।

এছাড়াও ‘ভারত নির্মাণ’ কর্মসূচি বিভিন্ন রাজ্যের উপর নির্ভরশীলতার জন্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এটি প্রাথমিকভাবে আমদানির প্রতিস্থাপনের একটি পুনরায় সংস্করণ হিসাবে বর্ণিত। এটি মূলত একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি দেশের আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্যকে চিহ্নিত করা হয়।

সেইসাথে ভূমি অধিগ্রহণ বিল সরকারের জন্য একটি প্রধান বাধা। এটি মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের উপর একটি গভীর প্রভাব ফেলেছে, যারা সাধারণভাবে নেতা এবং প্রশাসন উভয়ের প্রতি আশাভঙ্গ হয়েছেন। এই বিলের বৃহত্তম সমস্যাটি হল যে – এটি সল্প জমির মালিক ও সেইসাথে ভূমিহীন কৃষকদের উপর প্রভাব ফেলেছে, যারা ভারতের কৃষিভিত্তিক জনসংখ্যার সবচেয়ে অসহায় বিভাগ। কেন্দ্রকে আক্রমণের ক্ষেত্রে এটি বিরোধীদের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এছাড়াও দিল্লি নির্বাচনের ফলাফল এই দলের চিত্রকে কঠোরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে – মোদির অব্যাহত কার্যক্ষমতা সংক্রান্ত বহু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে – যিনি ২০১৪-এর সংসদ নির্বাচনের সময় দেখার মতন কাজ করেছেন।

মোদি সরকার গৃহীত কিছু পদক্ষেপ সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু কিছু বিতর্ক রয়েছে, যা বহু ধর্মীয় মানুষের কারনে সমালোচিত হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমন গীর্জা এবং ধর্ষণের মামলা দেশে প্রায়ই বেড়ে চলেছে। তাই, স্পষ্টতই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুফল দিচ্ছে না।

এখনো বহু অন্যান্য অবিবেচনাপূর্ণ সিদ্ধান্তের চেষ্টা এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা দমন করা হচ্ছে, যা মানুষের আশাভঙ্গ করছে। মোদী শ্রম বিভাগে বহু সংস্কার আনতে সক্ষম হননি। তবে, বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে এটি অর্জন করা খুব একটা সহজ নয়।

মোদি কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচি

More articles from :
Comments

(required)