পশ্চিম বঙ্গ
ভারতের বিভিন্ন মানচিত্র

পশ্চিমবঙ্গ নৃত্য

Dance of West Bengal in Bengali

পশ্চিমবঙ্গ নৃত্য

বিভিন্ন উদ্বেলিত অভিব্যক্তির অন্তর্নিহিত সারমর্ম প্রদর্শন-কারী নৃত্য ঐতিহ্য, বাংলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের বর্ণনা দান করে। বিগত শতাব্দীর দুই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও উদয় শংকর, বাংলার বিভিন্ন নৃত্য শৈলীকে পুরোভাগে নিয়ে আসতে এক গতিশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বাংলার বর্তমান নৃত্য শৈলী ভাবপূর্ণ শিল্প দক্ষতার একটি প্রলুব্ধ সীমাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা রাজ্যের অভিজ্ঞ নর্তক/নর্তকীদের দ্বারা পরিবেশিত হয়। নৃত্য-নাট্য বা নৃত্য নাটক এবং শাস্ত্রীয় নাচ একটি বিশেষ উল্লেখ দাবি করলেও, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আরও অন্যান্য চিত্তাকর্ষক নৃত্য শৈলী দেখা যায়।

টুসু পরব

টুসু পরবের সাংস্কৃতিক শিকড়ের উৎস বীরভূম জেলা। মকর সংক্রান্তির পবিত্র অনুষ্ঠানের সময়ে, টুসু পরব শুধুমাত্র বাংলার মেয়েদের দ্বারা পালিত হয়। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস, যাকে বাংলায় পৌষ বলা হয় তখন টুসু পরব স্থানীয় মানুষদের দ্বারা পালিত হয়।

বীরভূমের তরুণীদের এই পরবের সময় মাটি দিয়ে দেবী টুসুর মূর্তি তৈরী করতে দেখা যায়। মূর্তি তৈরি শেষ হলে, মেয়েরা কাছাকাছি কোন নদীতে গিয়ে একটি বা দুটি ডুব দিয়ে স্নান করে নিজেদের পবিত্র করে। স্নান করে মেয়েরা বিভিন্ন স্থানীয় গান গেয়ে দেবীর উপাসনা আরম্ভ করে। এই গান গুলিই বাংলায় টুসু নামে পরিচিত। এই অনুষ্ঠানে এক থালা চাল দেবীকে নিবদন করা হয়।

কিছু মেয়ে যখন ভক্তিমূলক গান গায় অন্যরা তখন এই গানের সাথে সুসংহত হয়ে নাচতে থাকে। বাংলার টুসু সঙ্গীত কোন বাদ্যযন্ত্রের সাথে যুক্ত নয়, এটি শুধুমাত্র কণ্ঠ বৈচিত্র্য দ্বারা সমৃদ্ধ।

ঝুমুর নৃত্য

বাংলার একটি প্রাচীন নৃত্য ঘরাণা ঝুমুর মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে যা বাংলায় চৈত্র বলে পরিচিত, তখন অনুষ্ঠিত হয়। পুরুষরা ঢোলের সাথে ঝুমুর নৃত্যের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী করে, অন্য দিকে নারীরা ধান বপনের সময় নাচ-গানের মাধ্যমে ঝুমুর নৃত্য করে।

ফসল উৎসবের এক পবিত্র রূপ হিসাবে পরিচিত বাংলার ঝুমুর, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার উভয়ের শাশ্বত প্রেমের সুন্দর গূঢ়ার্থ প্রকাশ করে। এই দুই পৌরাণিক ব্যক্তিত্বের উপাসনার সারাংশ বাংলার কৃষি-জমিতে ধান প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।

বাংলার পুরুষদের দ্বারা প্রদর্শিত নৃত্যশৈলী ঝুমুর হিসাবে পরিচিত। তবে, নারীরা যেই সংস্করণে অংশগ্রহণ করে তা আশরিয়া ঝুমুর নামে অভিহিত। তবে ঝুমুর সম্পর্কে এক আকর্ষণীয় সত্য হল-নর্তক/নর্তকীদের লিঙ্গ নির্বিশেষে এই নৃত্যের অন্তর্নিহিত মুল ভাব এক।

ছৌ নৃত্য

পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি এলাকায় সূচিত ছৌ-নৃত্য, বাংলায় সূর্য উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এই নৃত্য প্রদর্শনের সময় নর্তক-নর্তকী দ্বারা ব্যবহৃত রঙিন মুখোশের একটি অনন্য শৈল্পিক আকর্ষণ আছে। ছৌ নৃত্যের মূল ভাব দুই ঐতিহাসিক ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত-এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত।

বাংলায় ছৌ নৃত্যের সাধারণ গঠন কিছু পুরুষ দল নিয়ে গঠিত, যাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বর্গীয় চরিত্রের ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে কিছু জন দৈত্য-সংক্রান্ত ভূমিকা পালন করেন। এই নৃত্য প্রাথমিক ভাবে দুষ্ট শক্তিকে পরাক্রম করে সত্যের জয়কে বর্ণিত করে।

ছৌ-নর্তকরা নৃত্যের সময় বিভিন্ন রকমের পৌরাণিক চরিত্রের মুখোশ পরে থাকলেও, হাত-পায়ের সঞ্চালনার মাধ্যমে এই নৃত্য শৈলীর অভিব্যাক্তি প্রদর্শন করে। প্রবল্ লম্ফ-ঝম্ফ, এক পায়ে লাফান, এবং নর্তকদের অন্যান্য অনুরূপ উদ্যমশীল পদক্ষেপ ছৌ নৃত্যের মেজাজ স্থাপন করে।

বাংলার ছৌ নৃত্য প্রধানত রাত্রি বেলায় খোলা এলাকায় সাধারণত গ্রামের জমি, যেখানে নর্তকরা অবাধে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালন করতে পারে, সেখানে প্রদর্শিত হয়। ছৌ নৃত্যশিল্পিরা সাধারণত, সবুজ, লাল, হলুদ এবং কালো রঙের উজ্জ্বল বর্ণের পোশাক পরেন। যে সমস্ত পুরুষগণ দেবতাদের ভূমিকা পালন করেন তারা লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের পোশাক পরেন এবং যারা দুষ্ট চরিত্রের ভূমিকা পালন করেন তারা কালো পোশাক পরেন।

রায়বেঁশে নৃত্য

রায়বেঁশে নৃত্যের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। এই নৃত্যের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন কৃত্রিম যুদ্ধাস্ত্রের জাঁকালো গতিবিধির সাথে জড়িত। রায়বেঁশে নৃত্যশিল্পীরা ঢাল, লাঠি থেকে ত্রিশূল এবং বর্শা, সব ধরনের ঐতিহাসিক অস্ত্র ব্যবহার করে।

রায়বেঁশে নৃত্যের সেরা আকর্ষণ হল দক্ষ ব্যাক্তিদের দ্বারা মার্শাল অস্ত্র পরিচালনা, তাই এই নৃত্যকলা প্রদর্শন করার সময় নৃত্যশিল্পীদের প্রচন্ড সতর্ক থাকতে হয়। এক দিকে যেমন ঢোল এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র রায়বেঁশে নৃত্যে তাল সঙ্গত করে। অন্য দিকে, অস্ত্র-অভিনেতাদের মার্জিত প্রভুত্ব এই নৃত্যে একটি দুর্নিবার আবেদনের সৃষ্টি করে।

ভালভাবে অনুশীলন করার পরই রায়বেঁশে নৃত্য শিল্পীরা এক সার্বজনীন মঞ্চে প্রদর্শন করার অনুমতি পায়। রায়বেঁশে নৃত্য কলার প্রবীণরা এই নৃত্যের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সু-পরিচিত, তাই তারা জানেন যে কখন ও কিভাবে তাদের ভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। সোজা-শরীরের সঙ্গে নৃত্য রায়বেঁশে নৃত্যের এক অন্যতম প্রচলিত বৈশিষ্ট্য।

* সর্বশেষ সংযোজন : ১০ - ই এপ্রিল, ২০১৫