পশ্চিম বঙ্গ
ভারতের বিভিন্ন মানচিত্র

পশ্চিমবঙ্গ সমাজ

Society of West Bengal in Bengali

পশ্চিমবঙ্গ সমাজ

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এবং স্পন্দনশীল। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ বহু শতাব্দীর প্রাচীন ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত এই রাজ্যের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একজন সদস্য দেখা যাবে যে, যেকোন একটি শিল্পকলার সঙ্গে জড়িত। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ একটি বিশ্বজনীন সমাজ।

মহান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়দের অদ্বিতীয় অবদানে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ সমৃদ্ধ। নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার সংস্কৃতিতে নবজাগরণ এনেছেন। কলকাতার সাংস্কৃতিক আলোকায়ন কিছু প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে; যেমন – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা মেডিকেল কলেজ।

পশ্চিমবঙ্গের সমাজ একটি বিশ্বজনীন সমাজ। এই রাজ্যের জনসংখ্যা বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি এবং গোষ্ঠীর মানুষ নিয়ে গঠিত। বিশ্বজনীন প্রকৃতি সমাজকে আরো প্রাণবন্ত এবং গতিশীল করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বন্ধুত্বপূর্ণ এবং অমায়িক হয়, আপনি দুর্গা পূজা, দিওয়ালী এবং বড়দিনর উৎসবে এই রাজ্য পরিদর্শন করলে এটি বেশ স্পষ্ট ভাবেই অনুভব করবেন।

এই রাজ্যের সমাজ তার অনন্য সূক্ষ্মতার জন্যেও সুপরিচিত। যেই সব খাদ্য প্রেমীরা এখানে রসগোল্লা, ভাপা ইলিশ, লুচি, আলুর দম, মাছের কালিয়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারী আরও বহু খাবার উপভোগ করতে আসেন তাদের জন্য এটি এক উত্তম ভোজনসংক্রান্ত স্বর্গোদ্যান।

সংস্কৃতি

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের এক অন্যতম রাজ্য যা সমৃদ্ধ এবং ঐশ্বর্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সম্পন্ন। বিভিন্ন সম্প্রদায়, উপজাতি ও ধর্মীয় পটভূমি থেকে আগত মানুষরা এই রাজ্যে বাস করছে এবং বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান এবং রীতিনীতি অনুসরণ করছে, যা রাজ্যের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করে। এই রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিভিন্ন ভাষায এবং উপভাষার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।

বিভিন্ন শিল্পকলার রূপ যথা নাচ, গান এবং শিল্পকলায় পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ। এইসব ক্ষেত্রের প্রধান অবদানকারীরা হলেন – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বোস, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনি রায়, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিংকর বেজ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।

এমনকি সাহিত্য ক্ষেত্রেও বাংলা ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। বাংলার প্রধান কিংবদন্তি লেখকরা হলেন -কবি জয়দেব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এন সি চৌধুরী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতী রায়, সুকুমার রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং আরো অনেক। এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাউল সঙ্গীত, গম্ভীরা,ভাওয়াইয়া, ছৌ নাচ – এর মত বিভিন্ন লোক সঙ্গীত এবং নৃত্য দ্বারা প্রভাবিত।

মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনকে মেলা এবং উৎসব যেমন – দুর্গা পূজা, দিওয়ালী, হোলি, পয়লা বৈশাখ এবং আরো অনেক অনুষ্ঠান উদ্দীপিত করে। পাঁচদিন ধরে অনুষ্ঠিত দূর্গাপূজায় রাজ্যের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। দূরস্হান থেকে আগত লোকজন এই আধ্যাত্মিক উৎসবে বিমোহিত হয়।

সম্প্রদায়

পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। বাংলার মানুষের প্রথাগত পোশাক হল ধুতির সঙ্গে একটি জামা। আধুনিক শহুরে মানুষজন তাদের সুবিধার্থে পায়জামা ও ফুল প্যান্ট পরিধান পছন্দ করে। কিন্তু প্রবীণ মানুষজন এখনও এই প্রথাগত পোশাকটি উপভোগ করেন। গ্রামীণ এবং শহুরে উভয় এলাকার মহিলারা শাড়ি, ফুল প্যান্ট এবং সালোয়ার কামিজ ইত্যাদি পরিধান করে। পশ্চিমবঙ্গে ৪০-টি বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের উপজাতি দেখা যায়, তাদের মধ্যে কিছু হল- সাঁওতাল, মুনা, ওঁড়াও, লেপচা, এবং ভুটিয়া। এই উপজাতিরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক দশমাংশ নিয়ে গঠিত।

পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষই হিন্দু এবং হিন্দু-ধর্ম মত অনুসরণ করে। মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। কিছু মানুষ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং শিখ ধর্মের অন্তর্গত। এই রাজ্যে বিভিন্ন রকমের মানুষের বসতি থাকায় এটি একটি বিশ্বজনীন সমাজভুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের অন্যতম প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ। গ্রামীণ মানুষেরা চাল, গম, ডাল, সবজি ইত্যাদি চাষের সাথে নিযুক্ত, যা শুধুমাত্র রাজ্যেরই না বরং পুরো দেশের খাদ্যাদির প্রয়োজন মেটায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষরা বাংলয় কথা বলে, কিন্তু হিন্দি, পাঞ্জাবি, ভোজপুরি ভাষাও এখানে প্রচলিত।

পাঁচটি পৃথক বর্ণের প্রজাতি থেকে আগত মানুষরা পশ্চিমবঙ্গের বসবাস করে। প্রাচীনতম জাতির মূল উৎস হল প্রোটো-অস্ট্রেলিয়ান। নিষাদ হল প্রধানত এক ধরনের আদিবাসী গোষ্ঠী যাদের মালভুমি এবং ছোটনাগপুর এবং মধ্য ভারতের সংলগ্ন এলাকায় দেখা যায়। উপজাতিরা বেঁটে, লম্বা মাথা, কালো গায়ের রঙ এবং চওড়া নাক যুক্ত হয়। দ্রাবিড় জাতিরা লম্বা মাথা, লম্বা গঠন এবং তীক্ষ্ণ নাক যুক্ত হয়, যাদেরকে বাংলায় দেখা যায়। দার্জিলিং-এর অধিবাসীরা মঙ্গোলীয় জাতি। পঞ্চম জাতিটি হল আলপাইন বা ইন্দো-আর্য জাতি, যাদের ফরসা রঙ, টিকালো নাক এবং লম্বা শরীর।

পশ্চিমবঙ্গের কারুশিল্প

পশ্চিমবাংলাই সবসময় দেশের সংস্কৃতিক বাহিনীকে চালনা করছে। তা সে সঙ্গীত, শিল্পকলা বা কারুশিল্প যাই হোক – হস্ত নির্মিতবস্তু এবং হস্তশিল্পেও এই রাজ্যের এক দৃষ্টান্তমূলক দক্ষতা আছে। বাংলার বিভিন্ন শিল্পী ও কারিগরেরা বহুদিন ধরেই তাদের অত্যাশ্চর্য ও বর্ণময় হস্তশিল্প দেশ ও বিদেশে সরবরাহ করে। বাংলার কারুশিল্পকে অনেক ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, তাদের মধ্যে কয়েকটি হল –

  • চর্ম শিল্প
  • বাঁশ ও বেত
  • কাঁসা এবং পিতল
  • মাটির পুতুল
  • চীনামাটি
  • শৃঙ্গ ভাস্কর্য
  • পাটজাত পণ্য
  • চন্দন কাঠ খোদাই
  • তাঁত
  • মৃৎশিল্প
  • মঙ্গল ঘট
  • লক্ষ্মী ঘট
  • তুলসী মঞ্চ
  • মনসা ঘট
  • শাঁখের ভাস্কর্য
  • খোদাই
  • অস্থি খোদিত ভাস্কর্য
  • পাথর খোদিত ভাস্কর্য
  • কাঠের কাজ
  • ডোকরা ধাতু শিল্প
  • সিল্ক পর্দা

প্রতিটি সুক্ষ্ম কাজের নিজস্ব একটি স্বতন্ত্রতা আছে। বাংলার তাঁতিরা বিভিন্ন ধরনের শিল্প কাজে দক্ষ। জামদানি, কাঁথা এবং বিভিন্ন ধরনের তাঁত পণ্য বাংলার সমৃদ্ধ বয়ন শিল্পকে অনেকটাই ধরে রেখেছে। এই রাজ্য কিছু অসামান্য ধাতু ও পাথরের কারুশিল্পের সঙ্গেও আশীর্বাদ প্রাপ্ত। ধাতু ও পাথরের ভাস্কর্য, প্রদর্শনী দ্রব্য, গহনা ইত্যাদি এরই অন্তর্ভুক্ত। ডোকরা ধাতু কাজ হল হস্তশিল্পের এক অতি দুর্লভ রূপ, যা বাংলা ও পূর্ব ভারতের কিছু অন্যান্য জায়গায় পাওয়া যায়। বাংলার কারিগররা বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য কর্মে দক্ষ যেমন – পাথর, অস্থি, কাঠ জাত পণ্য এবং শাঁখের ভাস্কর্য।

মৃৎশিল্প

ভারতের পূর্বাঞ্চলের অন্যতম রাজ্য পশ্চিম বঙ্গ হস্তশিল্পের জন্য সুপরিচিত, এরই মধ্যে মৃৎশিল্প হল অন্যতম। পশ্চিমবঙ্গে, মৃৎশিল্পের ক্ষুদ্র শিল্পগুলি বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ এবং মেদিনীপুর জেলায় রয়েছে। সাধারণত গ্রামের নারী সম্প্রদায় এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কখনো কখনো পুরুষরাও মৃৎশিল্প তৈরীতে নিজেদের যুক্ত করে। পশ্চিমবঙ্গে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন বৈচিত্র্য দেখা যায়। সেগুলি মৃত্তিকা দ্বারা তৈরি এবং বিভিন্ন মাপ ও আকারে পাওয়া যায়। মৃৎশিল্প এক অন্যতম স্থানীয় হস্তশিল্প যা আদ্যিকাল থেকে রাজ্যে প্রচলিত আছে। এছাড়াও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে মৃন্ময় পাত্রাদি ব্যবহার করা হয়।

মঙ্গল ঘট হল মাটির ঘট যা সাধারন ভাবে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের কুম্ভকারদের দ্বারা আঁকা ও রং করা হয়। যেগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু গৃহের একটি অপরিহার্য বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মৃণ্ময় পাত্রাদি বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালির শুভকর্মে ব্যবহৃত হয় যেমন- বিবাহ অনুষ্ঠান, জন্মানুষ্ঠান এবং বিভিন্ন মঙ্গলজনক ধর্মানুষ্ঠান।

লক্ষ্মী ঘট বা ফুলদানি সাধারণত মঙ্গলজনক কর্মে জোড়ায় আনা হয়। এই জোড়া ঘটের একটি লক্ষ্মী বা ধনের দেবী এবং অন্য একটি প্রভু গণেশের জন্য বলে মানা হয়। লক্ষ্মী ঘট এছাড়াও লক্ষ্মী হিসাবে পরিচিত সম্পদ দেবীর পূজায় ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের ঘটকে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অন্যান্য মৃন্ময় পাত্রাদির মধ্যে সবথেকে মঙ্গলজনক হিসেবে গণ্য করা হয়।

মনসা ঘট বিভিন্ন আকারের পাওয়া যায়। এই মাটির পাত্রাদি সর্প দেবীকে সম্মান দেওয়ার জন্যে আঁকা হয়। এই অঙ্কন প্রধানত ঊর্ধ্বোত্থিত মৃন্ময় ঘটের উপর করা হয়। দেবীর মুখচিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি, সর্প ফণার চিত্রও এই ঘটের উপর আঁকা হয়।

তুলসী মঞ্চ মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় এবং কোথাও কোথাও ইট দ্বারা নির্মাণ করা হয়। এই মৃন্ময় মঞ্চে বিভিন্ন দেব দেবীদের প্রতিকৃতি অঙ্কণ করা হয় বিশেষত রাধাকৃষ্ণ। তুলসী মঞ্চ ভূমি থেকে প্রায় তিন থেকে চার ফুট উত্থাপিত করে একটি স্তম্ভ আকারে নির্মাণ করা হয়। সাধারণত এই স্তম্ভের ব্যাস প্রায় দেড় থেকে দুই ফুট হয়। এই চৌহদ্দির সব পক্ষ বাঁকা হয়। তুলসী মঞ্চের আকৃতি বিভিন্ন রকমের হতে পারে, আয়তক্ষেত্রাকার, অষ্টকোণী বা ষড়ভূজাকার। তুলসী মঞ্চের প্রতিটি দিকে বিভিন্ন দেব দেবীদের প্রতিকৃতি অঙ্কণ করা হয় বিশেষত রাধাকৃষ্ণ।

তুলসী মঞ্চ মাটিতে স্থাপন করা হয় এবং ধীরে ধীরে এর ভিতটি প্রশস্ত করা হয়। ইট দিয়ে সজ্জিত করার পর মাটি দিয়ে এর কাঠামোটি তৈরি করা হয়। তারপর একটি তুলসী বা বেসিল চারা রোপণ করা হয়। হিন্দুদের কাছে তুলসী গাছ খুবই পবিত্র এবং বিশুদ্ধ বলে মনে করা হয়। পরিবারের কল্যাণ কামনা করে তুলসী গাছ প্রতিটি হিন্দু গৃহে মহিলাদের দ্বারা পূজিত হয়।

শিল্পকলা

শিল্পকলা পশ্চিমবঙ্গের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ও প্রত্যেক গৃহের একটি অভিন্ন অংশ। রাজ্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা নাচ, গান, হস্তশিল্প এবং চিত্রকলা মিশে আছে। পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সমৃদ্ধকরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – এর অবদান অতুলনীয়। তিনি শতাব্দী জুড়ে নতুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী সঙ্গীতজ্ঞ এবং নর্তক-নর্তকীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আসছেন।

বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক নতুন ধারার কণ্ঠসংগীত সৃষ্টি করেন, যা তাঁর নামনুসারে ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’ নামে পরিচিত। এগুলি তাঁরই লিখিত এবং রচিত। প্রকৃতপক্ষে, এই গানগুলি বাংলা ভাষায় লেখা, যেগুলির পরে বহু অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের তৈরি এক বিদ্যালয় শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা শেখানো হয়, যা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি অর্জন করেছে এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে তা পরিচিত। ব্যালে নৃত্য শৈলী, উদয় শঙ্কর ও তার স্ত্রী অমলা শঙ্কর দ্বারা ভারতে প্রচলিত হয়েছে। রাজধানী শহর কলকাতায় তারা বহু নৃত্য শিল্পীদের এই শৈলীর প্রশিক্ষণ দেন এবং তাদের দল নিয়ে বিশ্ব জুড়ে নৃত্য শৈলী প্রদর্শন করেন।

চারুকলা ক্ষেত্রে, বাংলার শিল্পীরা তাদের অসাধারণ কাজের জন্য বিখ্যাত। এই বিখ্যাত শিল্পীরা ভারতীয় চারু ও কারু কলাকে একটি নতুন পথ প্রদর্শন করেছেন, উদাহরণ স্বরূপ – গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বোস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনি রায়, রামকিঙ্কর বেজ্। বাংলা লোকগিতিতে বাউল ঐতিহ্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। বহুসংখক অন্যান্য ধরনের লোকসঙ্গীত যেমন গম্ভীরা এবং ভাওয়াইয়ও প্রচলিত। শিল্প কলার অন্য এক রূপ নৃত্য, বাংলা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শাস্ত্রীয় নৃত্য যেমন – ভারতনট্যম, মণিপুরী, কত্থক এবং লোক শৈলী যেমন – ছৌ নাচ শিল্পীদের দ্বারা শেখান হয়। ছৌ-লোকনৃত্য পুরুষ নর্তক দ্বারা মুখোশ পরে প্রদর্শন করা হয়।

তাঁত

হস্তচালিত পন্যের মধ্যে তাঁত হল এক অন্যতম রূপ, যা পশ্চিমবঙ্গ আমাদের উপহার দিয়েছে। বাংলার শিল্প ও নৈপুণ্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সুসংগত রেখে, বাংলার তাঁত এবং তাঁতের শাড়ি ফ্যাশন ডিজাইনার্, শৈলী প্রেমী এবং ব্যবহারকারীদের কাছে অতি প্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলায় তাঁত শাড়ি ভূষিত জননীসুলভ চিত্র প্রত্যেক গৃহেই এক খুবই সাধারণ এবং প্রীতিজনক দৃশ্য। একটি ঐতিহ্যগত বাঙ্গালী মহিলার সবচেয়ে সম্ভাব্য চিত্রের বৈশিষ্ট্যটি হল লাল সাদা তাঁতের শাড়ির সঙ্গে লাল আঁচল। এই চমৎকার শাড়িটি বাঙ্গালীদের পূজায় এবং অন্যান্য উৎসবে অতি আবশ্যক। এটি খুব সহজেই উপলব্ধ করা যায় যে, তাঁত বাংলা ও সংলগ্ন এলাকায় অতি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ।

মসলিনের মত কড়কড়ে ও পালকের ন্যায় ওজনের জন্য তাঁত খুবই জনপ্রিয়। তাঁত শাড়ি সত্যিই আরামদায়ক ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য আদর্শ। শাড়ির পুরো গা জুড়ে থাকা চওড়া এবং রেশমী সুতোর কাজ সর্বোত্তম বাঙ্গালী নকশার এক চমৎকার উদাহরণ। এছাড়াও রঙিন তাঁত বস্ত্র সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি এবং জামা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তাঁতের শাড়ির আঁচল অথবা পল্লুটি সম্পূরক সুতোর কাজ দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়, যা এই পরিধানটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। আধুনিক মহিলাদের কাছেও তাঁত পোশাক খুব জনপ্রিয়, বিশেষত চাকুরীরতা মহিলা, যারা এটিকে দৈনন্দিন ব্যবহার ও অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতে পারেন, একই প্রানবন্ততার সঙ্গে।

অস্থি খোদিত ভাস্কর্য

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অদ্ভুত কারুশিল্পগুলির মধ্যে অস্থি খোদাই ভাস্কর্য বহু বছর ধরে প্রচলিত। ভারতের এই পূর্ব রাষ্ট্র সর্বদা ভারতের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে রয়েছে এবং হস্তনির্মিত সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী পণ্য এরই একটি অংশ।

পশ্চিমবঙ্গ গজদন্ত খোদাই ভাস্কর্যে বিশেষজ্ঞ এবং কারুশিল্পী গজদন্ত খোদাই করে সূক্ষ্ম শিল্পপণ্য তৈরি করে। গজদন্তের সাদা প্রতিভালিপ্ত হস্তনির্মিত পণ্যশিল্পের নিজস্ব একটি আভিজাত্য রয়েছে, যা অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী। গজদন্তের প্যানেল নির্মিত বিছানা, আলমারি, সাজসজ্জা করার টেবিল, কেদারা, সিংহাসন, পালকি ও অন্যান্য অনুরূপ পণ্য রাজা ও রানীদের কাছে খুবই ইপ্সিত ছিল। বাংলার কারিগর দ্বারা তৈরি গজদন্তের টেবিল বা পাত্র এই পরিবার গুলিতে খুবই প্রচলিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা এই বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের খাগড়া এবং জয়গঞ্জ সুরুচিপূর্ণ অস্থি খোদাই ভাস্কর্যের জন্যে এই জেলার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।

পশ্চিমবঙ্গে গজদন্ত খোদাই ভাস্কর্যে হিন্দু ও ইসলামী উভয় নকশাই করা থাকে, যা সব ধর্ম নির্বিশেষে সমান ভাবে পছন্দের। হিন্দু দেবদেবীর নকশা শিল্পকলায় খুবই সাধারণ। গজদন্ত নির্মিত মূর্তিগুলি তার সহজাত বহুমুখিতার জন্য আশ্চর্যকর। গজ ও অশ্বের নকশা টানা গজদন্ত নির্মিত পণ্য ও গহনা বাক্স খুবই জনপ্রিয় পণ্য। এই অলংকার বাক্স, বিশেষত রাজকীয় মহিলাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল।

এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের উভয় জেলা, বিশেষ করে নারায়ণ চক, তমলুক এবং জোত ঘনশ্যাম এলাকা পশু শৃঙ্গ দ্বারা নির্মিত চিরুনির জন্য সুপরিচিত। এটি গ্রামের লোকেরা খুব বেশী পরিমাণে ব্যবহার করে,কারন তারা বিশ্বাস করে যে এই পশু শৃঙ্গ নির্মিত চিরুনি মাথা ও চুলের জন্য উপকারী। কালো ও ধূসর রঙের চকচকে এই চিরুনিগুলির এক নিজস্বতা আছে।

পাথর খোদিত ভাস্কর্য

পাথর খোদিত ভাস্কর্য পশ্চিমবঙ্গে একসময় খুবই প্রচলিত ছিল। ক্রমাগত বাজারে অন্যান্য শিল্প আসার সাথে সাথে এই ভাস্কর্য অনেকটাই বিলুপ্তির পথে এসে গেছে। কিন্তু এখনও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিভাবান কারিগররা এই সুন্দর নৈপুণ্য পণ্য নির্মাণে অব্যাহত আছে, এবং তার এক নিজস্ব সৌন্দর্যশীলতা প্রদর্শন করে। এই ভাস্কর্য শিল্পীদের কোন প্রথাগত প্রশিক্ষণ নেই। তারা পূর্বপুরুষদের থেকে এই বুনিয়াদি শিক্ষা অর্জন করেছে এবং তাদের নিজস্ব জ্ঞান মিশ্রিত করেছে। শেষ পর্যন্ত, এটি সৌন্দর্যায়িত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের পাথর খোদাই ভাস্কর্য শিল্পীরা বিশেষত পাথরের পাত্র নির্মাণের সাথে নিযুক্ত। হস্তচলিত খোদাই বিভিন্ন আকার ও আকৃতির পাত্র নির্মাণ করতে ব্যবহৃত হয়। খোদাই করার উদ্দেশ্য ফাইলাইট পাথর ব্যবহৃত হয়, একটি অর্ধ-নরম ধূসর রঙের পাথর যা দিয়ে সহজেই খোদাই করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শিমূলপুর এই ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাথরের বাসনপত্র যত্ন সহকারে ব্যবহার করা প্রয়োজন, এই জন্যই বহু অন্যন্য উপকরণ সাধারণ মানুষদের কাছে বেশি প্রচলিত।

বর্ধমান, পাটুন ও দাঁইহাট-এর ভাস্কর অথবা সুত্রধররা তাদের সুক্ষ্ম পাথর খোদাই কাজের জন্য বিখ্যাত। তাদের খোদাই করার বিষয় হল মূর্তি এবং মন্দির ও গৃহের দেয়ালে খোদাই করা ক্ষুদ্র মানব মূর্তি। দণ্ডায়মান ভাস্কর্য তাদের কর্মক্ষেত্রের এক অবিশ্বাস্য উদাহরণ। পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরগুলিতে লাল ইট পাথরের ব্যবহার খুব প্রচলিত। এই মন্দিরগুলিকে আরও অলঙ্কৃত করার জন্য পাথর কেটে নকশা করা হয়। বিভিন্ন নকশা যেমন – হাতি, অশ্ব এবং দেবদেবী বঙ্গের মন্দিরগুলির এক প্রচলিত পাথর খোদিত ভাস্কর্য।

কাঁথা

বাংলার মহিলাদের দ্বারা বাহিত কাঁথা শিল্প বাংলার এক অসাধারণ সূচিকর্ম শিল্প। এই ধরনের গ্রামীণ সূচিকর্ম ব্যাপক ভাবে রাজ্যে ব্যবহৃত হয়। বাঙ্গালী পরিবারের মা ও বোনেরা কাঁথা শিল্পকে বিভিন্ন রূপে গ্রহন করেছেন, হয় গৃহস্থালী বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। কাঁথা শিল্প সমাজের আয়না রুপে কাজ করে, যার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে। তারা এই অপূর্ব রূপের হস্তচালিত শিল্পের মাধ্যমে তাদের স্বপ্ন এবং ইচ্ছাকে চিত্রাঙ্কন করে।

কাঁথা একটি সহজে চলমান সেলাই উপর ভিত্তি করে করা হয় কিন্তু এটি সেরা শিল্প কর্মের কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কাঁথার সরলতা এর অপরিমেয় জনপ্রিয়তার কারণ। কাঁথার উৎপত্তি কোঁথা-র সাথে সম্পর্কিত, সংস্কৃতে যার অর্থ ছিন্ন বস্ত্র। এটি বলা হয় যে বুদ্ধ দেবের শিষ্যরা ঠাণ্ডা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে একসাথে দুটি বস্ত্র সেলাই করতেন যাতে এটি মোটা ও উষ্ণ হয়। শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃতে উল্লেখ করা হয়েছে যে কাঁথা একটি নারীর আত্ম অভিব্যক্তি তুল্য।

শেষ পণ্যের উপর ভিত্তি করে কাঁথার বিভিন্ন নমুনা গুলি হল –

  • অর্চিলতা কাঁথা – ছোট, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আয়নার পর্দা রূপে ব্যবহৃত হয়।
  • দুরজানি বা থালিয়া – বেশিরভাগই মানিব্যাগ তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
  • বাঁইতো কাঁথা – বইয়ের এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীর আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার হয়।
  • সুজানি কাঁথা – এক আলংকারিক কাঁথা, যা অষ্টাদশ শতাব্দীর থেকে কম্বল হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
  • ওয়ার কাঁথা – যা আলংকারিক বালিশের আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
  • রুমাল কাঁথা – যা রুমাল ও পাত্রের আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

কাঁথা যে ভাবেই ব্যবহার হোক না কেন, এটি বাংলার মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দেওয়ালে ঝুলন্ত সামগ্রী (ওয়াল হ্যাঙ্গিং)

পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত ওয়াল হ্যাঙ্গিং, রাজ্যের কারিগরদের সমৃদ্ধ শৈল্পিক দক্ষতা এবং সৃজনশীল কল্পনাকে প্রতিনিধিত্ব করে। পশ্চিমবঙ্গের এক অন্যতম উদীয়মান শিল্প, হস্তজাত শিল্প বহু আলংকারিক পণ্য উৎপাদন করে।

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের এক অন্যতম পাট উৎপাদক রাজ্য। রাজ্যের হস্তজাত শিল্প থেকে পাটের বহু পণ্য উৎপাদিত হয় যেমন – সুন্দর ডিজাইনের গালিচা, আকর্ষণীয় পাটের থলি, পাটের রঙিন দুয়ারে পাতার মাদুর এবং অনেক অন্যান্য অলঙ্কারিক গৃহস্থালি পণ্য। ওয়াল হ্যাঙ্গিং, পশ্চিমবঙ্গের এই ধরণের এক ক্ষুদ্র কুটির ও গ্রামীণ শিল্পের রূপ।

পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় শিল্পীরা পাটের সূক্ষ্ম সুতো দিয়ে বুনে বিভিন্ন সুন্দর ওয়াল হ্যাঙ্গিং তৈরি করে। পাট তন্তুর প্রাকৃতিক সোনালী রঙ ওয়াল হ্যাঙ্গিংগুলিকে এক হলুদ এবং সোনালী বর্ণ প্রদান করে। আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে কারিগররা রঙিন রেশম সুতো এবং পুঁতি দিয়ে এই ওয়াল হ্যাঙ্গিংগুলিকে সুসজ্জিত করে।

এই ওয়াল হ্যাঙ্গিং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা প্রাপ্ত, রাজ্য পরিদর্শন করতে আসা যে কোন পর্যটক এটি ক্রয় করবে বলে ঠিক করেই রাখে। ওয়াল হ্যাঙ্গিং, বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিবেশন করা হয়। একদিকে ওয়াল হ্যাঙ্গিং, একটি অলঙ্কারিক উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয় যা গৃহের শোভা বাড়ায়, অন্যদিকে এটি স্মারক হিসাবে ব্যবহার করা হয় যা আপনজন এবং প্রিয়জনদের উপহার দেওয়া হয়।

হস্তকলা শিল্প পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির মেরুদন্ড। এই ক্ষুদ্রায়তন হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প থেকে রাজ্য, রাজস্বের এক বৃহৎ অংশ আয় করেন। হস্তজাত শিল্পের ওয়াল হ্যাঙ্গিং, অতীতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে, যা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান যুগের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

বালুচরি

বালুচরির রেশম ঐতিহ্য, যা শাড়ির পার্শ্বে ও আঁচলে জরি দ্বারা ভূষিত ব্যক্তিত্বমন্ডলীর নকশার জন্যে সুপরিচিত। শাড়ি ভারতীয় নারীদের প্রথাগত পরিধান। বিভিন্ন প্রকারের শাড়ি ভারতে জনপ্রিয়, যেগুলিকে তাদের বুনন, নকশা, অলঙ্কার ইত্যাদির ভিত্তিতে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। কিছু সাধারণ বৈচিত্র্যের শাড়ি হল – কাঞ্জিভরম, ইক্কত, বেনারসি, তাঁত, পোচামপল্লী, কোটকি সিল্ক, চান্দেরী, বালুচরি, গাড়োয়াল সিল্ক ইত্যাদি।

বালুচরি সিল্ক এক প্রকার রেশমের বয়ন, যার মধ্যে কারিগররা ভারতীয় পুরানের কাহিনী বয়নের মাধ্যমে লিখেছেন। এই শিল্প সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছু ফরাসি জ্যাকার্ড ধরনের তাঁতের সাহায্যে পুনর্জাগরিত করা হয়েছে। বালুচরি, ব্যাঙ্গালোর ও পশ্চিমবঙ্গের দুই ধরনের রেশমের সুতো দ্বারা বোনা হয়। এক বিশেষ তাঁত যন্ত্রে রেশম বুননটি উল্লম্বভাবে নির্ধারণ করা হয় এবং অন্যটি অনুভূমিকভাবে নির্ধারণ হয়। একটি শাড়ি তৈরি করতে কারুশিল্পীদের অনেক প্রচেষ্টা লাগে। এই রেশমের সুতোগুলিকে বোনার আগে ফুটন্ত জলে ধুয়ে নেওয়া হয়। পরের দিন, গরম রঙের মধ্যে ডুবিয়ে এগুলিকে রঙ্গীন করা হয়। তারপর এই সুতো গুলিকে ঘূর্ণমান চাকায় ঘোরান হয়। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর আমরা এই সুন্দর বালুচরি শাড়ি পাই।

ঢাকাই জামদানি

বিভিন্ন ধরনের হাতে বোনা বস্ত্রের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিল্প ঐশ্বর্য ও নৈপুণ্য প্রতিফলিত হয়। এই নিদারূণ হস্তচালিত-তাঁত পণ্যের মধ্যে ঢাকাই বা ঢাকাই জামদানি একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র শৈলী বজায় রাখে। সুতির শাড়ির উপর বোনা ঢাকাই-এর নকশা বহু বছর ধরে খ্যাতি অর্জন করে আসছে। এই শব্দটির উৎপত্তি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে হয়েছে। নামানুসারে এই হস্তচালিত তাঁত শৈলী মূলত ঢাকাতে এবং অবিভক্ত বাংলার কিছু অন্যন্য অংশে প্রচলিত ছিল, কিন্তু বঙ্গ ভঙ্গের পর এটি পশ্চিমবঙ্গেও প্রচলিত হয়। ঢাকাই শৈলী সুতি বস্ত্রের উপর বোনা হয়। এই ঢাকাই সাধারন ভাবে সুতি বস্ত্রের উপর বোনা হয়, কিন্তু যখন এটি রেশম বস্ত্রের উপর বোনা হয় তখন একটি চাকচিক্যময় ঢাকাই-এর সৃষ্টি হয়।

বাংলা ও ভারতের অন্যান্য অংশের মহিলাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢাকাই শাড়ি পরিধান বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশী ঢাকাই শাড়িগুলি বেশিরভাগই ধূসর রঙের হয়, কিন্তু ভারতীয় সংস্করণগুলি বিভিন্ন রঙের হয়। সোনালি ও রুপালি জরির কাজ করা ধূসর কালো ঢাকাই যে কোন মহিলার দখলে থাকা বেশ ঈর্ষনীয় এবং এটি দেশের এক অন্যতম রুচিশীল শাড়ি। ঢাকাই জামদানি শাড়ির সুক্ষ জমিন, প্রায় নিখুঁত শোভাময় মসলিনের অনুরূপ। বাংলার ওপার থেকে আগত এই বিস্ময়কর ঢাকাই শাড়ি বর্তমানে ভারতের গর্ব। এটি দেশের একটি গুরত্বপূ্র্ণ রপ্তানিকারক উপাদান।

* সর্বশেষ সংযোজন : ১০ - ই এপ্রিল, ২০১৫