পুদুচ্চেরি সম্পর্কে
পুদুচ্চেরির আদি নাম হল পন্ডিচেরি। ভারতীয় ও বিদেশীদের কাছে এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান, একে পূর্বের ফরাসি রিভেরা বলে মানা হয়।
পুদুচ্চেরি হল ভারতের সুন্দর শহরগুলির মধ্যে এক অন্যতম শহর, এর অসাধারণ আকর্ষণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে পর্যটকেরা এখানে এসে উপস্থিত হয়। এই সুপরিকল্পিত শহরে ফরাসি প্রভাব লক্ষণীয়, তাই এটি পর্যটকদের আকর্ষিত করে।
পুদুচ্চেরির ইতিহাস
এর আসল নাম পুদুচ্চেরি কিন্তু ফরাসিরা একে পন্ডিচেরি বলে অভিহিত করত। এই নামের অর্থ হল নব-নিষ্পত্তি বা নব-শহর।
এটিও তার সাথে প্রমাণিত যে খ্রীষ্টিয় প্রথম শতকে রোমানরাও এই রাজ্য পরিদর্শন করে গেছেন। খ্রীষ্টিয় চতুর্থ শতকের প্রথমদিকে পল্লব রাজারা এই রাজ্যে রাজত্ব করতেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণ বংশীয় রাজা চোল, পাণ্ডা এবং বিজয়নগর এবং তারও পরে মাদুরাই-য়ের সুলতানরা এখানে রাজত্ব করেন। ১৬৭৪ সালে ফরাসি রাজ্যপাল ফ্রাঙ্কোইস মেরিন এই ছোট্ট মাছ ধরার গ্রামটিকে একটি মহাবন্দর নগরীর রূপ দান করেন।
ফরাসি দের পদার্পণে পুদুচ্চেরি একটি বিখ্যাত শহরের রূপ নেয়। ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে বহু যুদ্ধ হলেও, অবশেষে ফরাসিদের হাতেই পুদুচ্চেরির ক্ষমতা রয়ে যায়। ১৮ শতকের সময় থেকে এই শহরে উন্নতি লক্ষ্য করা যায়।
পুদুচ্চেরির ভৌগলিক অবস্থান
এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি মোট ৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এবং এই রাজ্যটি ৪-টি অসংবদ্ধ জেলা নিয়ে গঠিত, যথা – পুদুচ্চেরি, করাইকল, ইয়ানম ও মাহে। মাহে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত এবং বাকি তিনটি জেলা বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। সবচেয়ে বড় অংশ পুদুচ্চেরি ও করাইকল তামিলনাডুর পরিক্ষেত্রতে অবস্থিত। মাহে এবং ইয়ানম কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশের পরিক্ষেত্রতে অবস্থিত। পুদুচ্চেরি জেলা ২৯৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা, করাইকল ১৬০ বর্গ কিলোমিটার, ইয়ানম ৩০ বর্গ কিলোমিটার এবং মাহে ৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গঠিত।
পুদুচ্চেরি জেলা ভারতের পূর্ব উপকূলবর্তী চেন্নাই শহরের ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। করাইকল পূর্ব উপকূলবর্তী পুদুচ্চেরির থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইয়ানম অন্ধ্রপ্রদেশের পূর্ব উপকূলে অবস্থান করে আছে এবং মাহে কেরালার পশ্চিম ঘাটে অবস্থিত।
পুদুচ্চেরির জলবায়ু
সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল হওয়ার কারনে এখানকার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। এখানকার গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা প্রায় ৩৮ ডিগ্রি, শীতকালীন তাপমাত্রা মনোরম হয়। নভেম্বর থেকে শীতকাল আরম্ভ হয় এবং এই সময়কালীন তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির নীচে নামে না। উত্তর পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এখানকার মাটিতে জুলাই থেকে আগস্ট এবং নভেম্বর থেকে জানুয়ারি অবধি বৃষ্টিপাত ঘটায়। গ্রীষ্মকাল মার্চ থেকে জুলাই অবধি থাকে। বর্ষাকালের সাথে সাথেই শীতকালও প্রবেশ করে যায়। পর্যটকদের এখানে ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ভ্রমণের উপদেশ দেওয়া হয়।
পুদুচ্চেরিতে শিক্ষা
দেশের অন্যান্য অংশের চেয়ে এই কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে উচ্চ শিক্ষিতের হার তুলনামূলক ভাবে বেশী। এখানে আপনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখতে পাবেন যেগুলি সবরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অসাধারণ। এখানে অনেক মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় দেখা যায় যেগুলি বিদেশীদের মধ্যেও বিখ্যাত যেমন–পুদুচ্চেরি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পুদুচ্চেরি বিশ্ববিদ্যালয়।
এখানে বিভিন্ন রকমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যনীয়, যথা–বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা কেন্দ্র এবং দূরশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানকার একটি অতি মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো – ‘শ্রীঅরবিন্দ আন্তর্জাতিক শিক্ষা কেন্দ্র’ যা অরবিন্দ আশ্রম এর একটি অংশ।
এখানকার মহাবিদ্যালয়গুলিতে যেই বিষয় গুলি উপলব্ধ সেগুলি হল যথাক্রমে- (সিভিল, যান্ত্রিক, রাসায়নিক, এবং ইলেক্ট্রনিক্স), কম্পিউটার বিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, মানবিক এবং আরো অনেক। যারা চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে শিক্ষা গ্রহন করতে চান তাদের জন্যে এখানে কিছু চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এছাড়াও এর পাশাপাশি কিছু দন্তচিকিৎসা, জৈবপ্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা, স্থাপত্য, আইন, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি মহাবিদ্যালয়ও গড়ে উঠেছে। যোগ্য প্রার্থীদের জন্য বৃত্তি, ঋণ ও আরো অন্যান্য সুবিধাও উপলব্ধ রয়েছে। এই মহাবিদ্যালয়গুলি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে আবাসালয়ের ব্যবস্থাও করে।
দেশের অন্যান্য অংশের থেকে পুদুচ্চেরি তে সাক্ষরতার হার ভাল, প্রায় ৮৬.৫৫ শতাংশ।
সমাজ ও সংস্কৃতি
পুদুচ্চেরি একটি মিশ্র সংস্কৃতির অধিকারী। অনেকগুলি সংস্কৃতি মিশ্রিত হয়ে একটি সংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। পুদুচ্চেরি সাধারণত দ্রাবিড়িয় এলাকাভুক্ত হওয়ার কারনে এখানকার অধিকাংশ মানুষ দ্রাবিড়। ফরাসি সংস্কৃতি ও চরিত্রের অন্তর্গত হওয়া সত্ত্বেও এই জায়গাটি সত্যিই ভারতীয়। এখানের মূল মানুষজন তামিল সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হলেও এখানে অনেক ভারতীয় ও বিদেশী লক্ষ্য করা যায়। এক দশক আগে ফরাসিদের অবসান ঘটলেও, আপনি ফরাসি সভ্যতাকে আজও অনুভব করতে পারবেন। এটি একটি বহু–জাতিক ও বিশ্বজনীন সভ্যতাভুক্ত রাজ্য। বহুজাতিক সভ্যতার সংমিশ্রণের ফলে এটি একটি আকর্ষক বহুসংস্কৃতিক শহরের রূপ ধারন করেছে, যার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। এখানকার যে শিল্প আপনি দেখেন তা ঐতিহ্যগত এবং এখানকার বিখ্যাত কারুশিল্প যা আপনি কিনতে পারেন তা হল পুদুচ্চেরির বোম্মাই।
এখানকার খাদ্য এককথায় অত্যন্ত সুস্বাদু। এখানকার খাদ্যের স্বাদ স্থানীয় স্পর্শে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের হয়। ফরাসি স্পর্শ ও স্থানীয় স্পর্শ মিলেমিশে একাকার হয়ে এখানকার খাদ্যের স্বাদকে এক আলাদা মাত্রা দান করে। এখানে আপনি এমন অনেক সুন্দর রেস্তোরাঁ দেখতে পাবেন যেগুলি মালায়ালম, বাঙ্গালি, পাঞ্জাবি ও তামিল ভোজনের বিশেষত্বযুক্ত।
ভাষা
যেহেতু পুদুচ্চেরি একটি বিবিধ সংস্কৃতি সম্পন্ন রাজ্য তাই এখানে বহু ভাষা লক্ষণীয়। এখানকার বহু সংখ্যক মানুষ দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলে যেমন– তামিল, তেলেগু ও মালায়ালম। এখানে অনেকে ফরাসি ও ইংরাজি ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে। এখানকার বিদ্যালয় গুলিতে তামিল, তেলেগু ও মালায়ালম এর পাশাপাশি ফরাসি ও ইংরাজি মাধ্যমেও শিক্ষা দান করা হয়। কিন্তু এখানে ইংরাজি ভাষায় সবথেকে বেশি কথা বলা হয়। পুদুচ্চেরির আধিকারিক ভাষা গুলি হল-তামিল, তেলেগু, মালায়ালম ও ফরাসি। এই ভাষা প্রতিটি জেলায় জেলায় পরিবর্তনশীল। সরকারি দপ্তরগুলিতে ইংরাজি ভাষা ব্যবহৃত হয়।
সরকার ও রাষ্ট্রনীতি
পুদুচ্চেরির জেলা-সরকার মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়োগ করে থাকেন, যিনি বিধানসভার সদস্য হিসাবে নামাঙ্কিত হন। তিনি সরকারের বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বে থাকেন এবং শহর পরিকল্পনা, অন্তঃশুল্ক, সরকারি কার্যকলাপ, অর্থ পরিকল্পনা, সাধারন প্রশাসন, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, গোপনীয় কর্ম, মন্ত্রিসভা ও নাগরিক সভা ইত্যাদির পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক দলগুলি এই কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলের প্রগতির জন্য যৌথপ্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। পুদুচ্চেরি সরকার- লেফটেন্যান্ট গভর্নর, মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রী, বিধায়ক এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত। অন্যান্য রাজ্যগুলির মতো পুদুচ্চেরি সরকারের একটি বিধানসভা আছে যা ৩০-জন সদস্য নিয়ে গঠিত। বিধান সভার সদস্যরা ৫ বছরের জন্যে নিয়োজিত হন এবং এই সদস্যরা সরকারি বিষয়গুলির দেখাশোনা করেন।
কেন্দ্রশাসিত প্রদেশ পুদুচ্চেরিতে মাত্র একটি লোকসভা ক্ষেত্র বর্তমান। পুদুচ্চেরি রাজ্যের প্রগতির পরিবর্তনের পথে বহু রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আছে। এই রাজ্যে যেসব রাজনৈতিক দল গুলির প্রভাব বেশি লক্ষনীয় সেগুলি হলো – কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি [বি.জে.পি]।
পুদুচ্চেরির অর্থনীতি
পুদুচ্চেরির বেশিরভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর এবং ৯০ শতাংশ সেচ এলাকাভূক্ত। এখানকার বিভিন্ন ফসলগুলি হল চাল, সুপারি, রাগি, তুলা, ডাল, বাজরা, বাদাম ও আখ। এখানে দুগ্ধ শিল্প অত্যন্ত আধুনিক এবং এই খাতে উচ্চ আয় দেখা যায়। এখানকার আরও একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনীতি হল মৎস্য জীবিকা, যেখানে প্রায় ২৮-টি গ্রাম মৎস্য জীবিকার অন্তর্গত।
পুদুচ্চেরিতে বহু ক্ষুদ্র, বৃহৎ ও মধ্যম মাপের শিল্প আছে। এখানকার জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শিল্পায়ন খাতে নিযুক্ত। এখানকার শিল্প গুলি হল– কম্পিউটার, বৈদ্যূতিক পণ্য, ঔষধ, চিনি, তুষ তেল, ছাদ শীট, চামড়াজাত পণ্য, ইস্পাত টিউব, স্পিরিট, ভূ-সংক্রান্ত সরঞ্জাম, যানবাহনের অংশ ইত্যাদি ।
পুদুচ্চেরির জনসংখ্যা
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পুদুচ্চেরি জেলার মোট জনসংখ্যা হল প্রায় ১,২৪৪,৪৬৪। এখানকার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনঘনত্ব হল ২,৫৯৮। এখানে প্রতি ১০০০-জন পুরুষের অনুপাতে মহিলার সংখ্যা হল প্রায় ১০৩১ জন।
পুদুচ্চেরির পরিবহন
ফরাসি সভ্যতার জন্য পুদুচ্চেরি আন্তর্জাতিক স্তরে খুবই খ্যাত এবং এই কেন্দ্রশাসিত প্রদেশের প্রতিটি ভাগে ছড়িয়ে থাকা সড়ক ব্যবস্থা খুবই উন্নত। এখানকার জাতীয় সড়ক অন্যান্য রাজ্য গুলির মধ্যে সু–সংযোগ স্থাপন করেছে। এখানে বাস, বেসরকারি যানবাহন সর্বত্র উপলব্ধ। এখানে নিয়মিত ভাবে বহু বাস পাওয়া যায় যা প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর চেন্নাই যায়।
পুদুচ্চেরি শহরে একটি বিমান বন্দরও উপলব্ধ, যদিও এটি একটি অন্তর্দেশীয় বিমানবন্দর। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর চেন্নাই-এ অবস্থিত।
পর্যটন
প্রতিটি পর্যটকের কাছে এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক স্থান। আরাভিল হল পুদুচ্চেরির একটি অতি জনপ্রিয় গন্তব্য। ফরাসি আবাসন, খাদ্য ও ফরাসি সভ্যতা এখানকার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। আপনি এখানে বিশ্ব-সেরা সমুদ্র সৈকত পাবেন। তাই যদি আপনি রৌদ্র ও জলরাশি পছন্দ করেন তাহলে আপনি সেটা এখানে মন ভরে উপভোগ করতে পারবেন।
এখানকার সমুদ্র সৈকত গুলি খুবই শান্ত ও সুন্দর। সমুদ্র সৈকতে বহু গাছ সারিবদ্ধভাবে রয়েছে। এছাড়া, আপনি এখানে বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ দেখতে পাবেন, যেমন-গীর্জা, ঔপনিবেশিক ভবন, প্রাচীনকালে নির্মিত মন্দির, বোটানিকাল গার্ডেন, জাদুঘর এবং আরো অনেক কিছু। ১৯২৬ সালে নির্মিত অরবিন্দ আশ্রম হল ভারতীয় ও বিদেশী পর্যটকদের একটি প্রধান আকর্ষণ। পুদুচ্চেরি একটি সম্মানীয় শিক্ষা কেন্দ্র।
|